যে ইতিহাস একদিন তিন মহাদেশজুড়ে এক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে, তার সূচনা হয়েছিল এক ছোট গোত্রের নিঃশব্দ যাত্রা দিয়ে। এবং সেই যাত্রার পুরোভাগে ছিলেন এক বীরপুরুষ, যিনি সময়কে বদলে দেয়ার সাহস নিয়ে পথ দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যৎকে। তাঁর নাম—এরতুগ্রুল গাজী।
আজকের পাঠক সমাজে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে যেন এক ধরনের দুর্ভাবনাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই মনে করে, ইতিহাস মানে পুরনো কিছু স্মৃতির জঞ্জাল—যার সঙ্গে বর্তমানের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, ইতিহাস না জানার মানে হচ্ছে নিজের পরিচয় ভুলে বসে থাকা। জাতি হিসেবে আমরা কোথা থেকে এসেছি, কীভাবে দাঁড়িয়েছি, আর কতটা দিকহারা হয়ে উঠেছি—এই উত্তরগুলো পাওয়া যায় ইতিহাসেই।
এরতুগ্রুল গাজীর নাম আমরা অনেকেই কেবল জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ থেকেই শুনেছি। কিন্তু খুব অল্প মানুষই জানে, এই মানুষটির ভেতর কী ধরনের দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগ এবং রাজনৈতিক বোধ কাজ করেছিল—যা পরবর্তীতে রূপ নিয়েছিল উসমানী সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসেবে।
তেরো শতকের শুরুতে তুর্কি গোত্রগুলো ছিল ছিন্নভিন্ন, বিপন্ন। মোঙ্গলদের তাণ্ডবে অনেক গোত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সীমানা ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, আর মুসলিম রাজ্যগুলো ছিল চরম দুর্বলতায় জর্জরিত। এরতুগ্রুল তখন কায়ি নামের এক ক্ষুদ্র গোত্রের নেতা। তাঁর সামনে কোনো রাজ্য ছিল না, সেনাবাহিনী ছিল সীমিত, এবং সম্ভাবনাও ছিল অস্পষ্ট। তবুও, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন—একদিন এমন একটি ভূমি হবে, যেখানে আল্লাহর নামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, যেখানে দুর্বল মুসলমানরা আশ্রয় পাবে, এবং যেখানে একটি স্বাধীন, আত্মমর্যাদাশীল জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবে।
তাঁর এই স্বপ্ন কল্পনা নয়—দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় গড়া। এরতুগ্রুলের নেতৃত্বে কায়ি গোত্র আনাতোলিয়ার সোগুত অঞ্চলে এসে স্থায়ী হয়। তিনি এই সীমান্ত অঞ্চলে শুধু যুদ্ধ করেননি, বরং এক ন্যায়ভিত্তিক শাসনের বীজ বপন করেছিলেন—যেখানে ইসলামি মূল্যবোধ, সামাজিক সংহতি, এবং আত্মনির্ভরতা ছিল মূল ভিত্তি।
তিনি সেলজুক সুলতানের পক্ষে যুদ্ধ করে আস্থা অর্জন করেন, এবং এর পুরস্কারস্বরূপ পান সোগুত। এই সোগুতই পরে হয়ে ওঠে উসমানী সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী। এরতুগ্রুল তাঁর গোত্রকে রক্ষা করেই থেমে যাননি—তিনি ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি গড়েছেন। তিনি জানতেন, তাঁর কাজ সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি হয়তো ইতিহাসের রূপ বদলে দেবে।
তাঁর পুত্র ওসমান গাজী সেই উত্তরাধিকার বহন করেন, যিনি এরতুগ্রুলের স্বপ্নকে পরিণত করেন বাস্তবতায়—প্রতিষ্ঠা করেন উসমানী সাম্রাজ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রতিটি গাছের শুরু হয় একটি বীজ দিয়ে। ইতিহাসের সেই বীজবপনকারী ছিলেন এরতুগ্রুল গাজী।
আজ যখন আমরা নিজেদের অতীত ভুলে পশ্চিমা সংস্কৃতির বন্যায় ভেসে যাচ্ছি, তখন আমাদের উচিত এই মানুষদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া। তারা কীভাবে জাতি গঠন করেছেন, কীভাবে বিশ্বাস, ত্যাগ আর আত্মমর্যাদার উপর দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছেন—এই গল্পগুলো জানাই আমাদের আত্মপরিচয় রক্ষার প্রথম ধাপ।
এই সিরিজের শুরুতে আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই শিকড়ে, যেখান থেকে উঠে এসেছিল এক অনন্য রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরাশক্তি—উসমানীয় সাম্রাজ্য। এর পর্বে পর্বে আমরা জানবো তাদের উত্থান, শাসনব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি, সংস্কৃতি, নারীদের ভূমিকা, পতনের কারণ, এবং পশ্চিমা ইতিহাসের অপপ্রচারের জবাব।
কিন্তু এই পথচলার প্রথম ধাপেই আমরা মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাই সেই মহাপুরুষকে, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন—আর সেটিকে উত্তরাধিকারে রূপ দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের জন্য। তাঁর নাম, ইতিহাসের শুরুর পাতায় লেখা থাকবে চিরকাল—এরতুগ্রুল গাজী।
---
পরবর্তী পর্বে থাকছে:
উসমান গাজী—একটি বংশ নয়, একটি আদর্শের শুরু। সবাই পাশে থাকবেন ও ইতিহাস জানার জন্য নিজেকে আগ্রহী করে তুলবেন।