এপিসোডটি দেখতে নিচের দিকে যান!
ফাতিহ সুলতান মেহমেদ ও কনস্টান্টিনোপল: নতুন যুগের সূচনাঃ-
পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ায় ইউরোপ ও এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র এক গভীর রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তখন প্রায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল কেবল কনস্টান্টিনোপল নগরীতে। বাকি সব প্রদেশ একে একে অটোমানদের হাতে চলে গেছে, অর্থনৈতিক ভরসা দুর্বল হয়েছে, সেনাবাহিনী ক্ষয়প্রাপ্ত। অপরদিকে অটোমান সাম্রাজ্য দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে, বলকান থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত তাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে কনস্টান্টিনোপলের কৌশলগত গুরুত্ব নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়—কারণ এটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যপথের চাবিকাঠি, অর্থনৈতিক আধিপত্যের মূল দ্বার, এবং ধর্মীয় ভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ।
১৪৩২ সালে জন্ম নেওয়া মেহমেদ ছিলেন এক দূরদর্শী, উচ্চাভিলাষী ও শিক্ষা-অনুরাগী রাজপুত্র। পিতা সুলতান মুরাদ দ্বিতীয় তাঁর শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগ দেন। ইসলামি ফিকহ, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান—প্রতিটি বিষয়েই তাঁকে দক্ষ করে তোলা হয়। আরবী, ফার্সি, লাতিনসহ একাধিক ভাষা শিখে মেহমেদ অল্প বয়সেই আন্তর্জাতিক কূটনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করেন। সামরিক কৌশল ও দুর্গবিদ্যা সম্পর্কিত বই তাঁর শখের তালিকায় ছিল। এ শিক্ষা-দীক্ষা ভবিষ্যতে তাঁকে এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করে।
কনস্টান্টিনোপল দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী বিশ্বের স্বপ্নের নগরী ছিল। মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিসে এর বিজয়ের সুসংবাদ থাকায় মুসলিম সেনারা বহুবার অবরোধ করলেও সাফল্য মেলেনি। ফলে অটোমান শাসকদের কাছে এটি ছিল মর্যাদা ও কৌশল—উভয়েরই প্রতীক। শহরটি দখল করতে পারলে কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমুদ্রপথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মিলবে, এবং অটোমান সাম্রাজ্য হবে একটি সমুদ্রশক্তি। অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাণিজ্য করিডোরের ওপর অটোমানদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে।
মেহমেদ সুলতান হওয়ার পরপরই বুঝতে পারেন, শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর শক্তি দিয়ে নয়, প্রযুক্তি, কূটনীতি এবং পরিকল্পনার সমন্বয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করতে হবে। ১৪৫২ সালে তিনি বসফরাসের উত্তর তীরে রুমেলি হিশার দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ কার্যত কনস্টান্টিনোপলের জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, বাইজেন্টাইনের সরবরাহ পথ সীমিত করে দেয়। একই সাথে তিনি হাঙ্গেরীয় প্রকৌশলী অরবানকে দিয়ে বিশাল কামান তৈরি করান, যা সমসাময়িক যুগে বিরল। এই কামান, “শাহী টপ” নামে পরিচিত, এত বড় ছিল যে এর গুলি প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হয়।
৬ এপ্রিল ১৪৫৩, অটোমান বাহিনী শহর ঘিরে ফেলে। প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য, অশ্বারোহী, কামানবাহিনী ও শতাধিক জাহাজ এই অভিযানে অংশ নেয়। বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টান্টিন একাদশের হাতে ছিল মাত্র ৭ হাজার রক্ষী, তবুও তারা সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ চালায়। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে শহরের চারদিক থেকে কামান বর্ষণ, নৌ-যুদ্ধ, খননকাজ ও রাত্রিকালীন আক্রমণ অব্যাহত থাকে। মেহমেদ নিছক বলপ্রয়োগে নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ও ঘনিষ্ঠ তদারকির মাধ্যমে সৈন্যদের উদ্দীপিত রাখেন। সেনাদের ধর্মীয় ও নৈতিক প্রেরণা বাড়াতে তিনি ধারাবাহিকভাবে খুতবা ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালান।
২৯ মে ১৪৫৩ ভোরে চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে দুর্বল বাহিনী আক্রমণ করে রক্ষীদের ক্লান্ত করে তোলে, এরপর মূল সেনাদল প্রবল আঘাত হানে। বহু ঘণ্টার সংঘর্ষ শেষে শহরের প্রাচীর ভেঙে পড়ে। সম্রাট কনস্টান্টিন একাদশ যুদ্ধে নিহত হন এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হাজার বছরের ইতিহাসের অবসান ঘটে। কনস্টান্টিনোপল অটোমানদের অধিকারে আসে এবং “ইস্তানবুল” নামে নতুন অটোমান রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়।
এই বিজয় বিশ্ব ইতিহাসের এক মাইলফলক। ইতিহাসবিদরা একে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূচনা বলে থাকেন। কারণ, কনস্টান্টিনোপল পতনের ফলে ইউরোপীয় বণিকরা পূর্বের বাণিজ্যপথ হারিয়ে নতুন সমুদ্রপথ অনুসন্ধানে বের হয়। এই অনুসন্ধানই পরে আমেরিকা আবিষ্কার ও বিশ্ববাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক হয়। একই সঙ্গে ইস্তানবুলে অটোমান শাসন শুরু হওয়ায় ইসলামি সংস্কৃতি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের নতুন বিস্তার ঘটে।
মেহমেদ সুলতান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি কেবল সামরিক নায়ক নন, বরং সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। গ্রিক, ইহুদি, আর্মেনীয়সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করেন, ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় রাখেন। বহু মসজিদ, পাঠাগার, মাদ্রাসা ও বাজার নির্মাণের মাধ্যমে ইস্তানবুলকে এক প্রাণবন্ত মহানগরীতে পরিণত করেন। টপকাপি প্রাসাদ তাঁর রাষ্ট্রনায়কত্ব ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী নিদর্শন হয়ে আছে।
ফাতিহ সুলতান মেহমেদের নেতৃত্ব আমাদের শেখায়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ও নৈতিক প্রেরণা মিললে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। ইতিহাসে কনস্টান্টিনোপলের বিজয় প্রমাণ করেছে—দূরদর্শী নেতার হাতে একটি সাম্রাজ্য শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের মাধ্যমেও সমৃদ্ধ হতে পারে। এই ঘটনাই নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়ে বিশ্বের ভূরাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
আজকের দিনে “Fatih Sultan Mehmed: Yeni Çağ” সিরিজ সেই ঐতিহাসিক অধ্যায়কে দৃশ্যমান করে তুলেছে। ডকু-ড্রামা ফরম্যাটের মাধ্যমে গবেষণা, দলিল ও নাটকীয় পুনর্নির্মাণের মিশ্রণ দর্শকদের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এটি শুধু বিনোদন নয়, ইতিহাসের শিক্ষা—যেখানে দেখা যায় কীভাবে এক তরুণ সুলতান সাহস, জ্ঞান ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
সার্ভার ১:-